Poems of Malay Roychoudhury

Poems of Malay Roychoudhury
Cover design by Murshid A M

Saturday 31 July 2010

Malay Roychoudhury's Self-Interview

এই সাক্ষাৎকারের ধারণাটি 'দাহপত্র' পত্রিকার সম্পাদক কমলকুমার দত্তর । তিনিই প্রস্তাব দেন যে নিজের সঙ্গে নিজে কারোর সাক্ষাৎকার নেবার নজির সম্ভবত বাংলায় নেই । মলয় রায়চৌধুরীকে তিনি প্রস্তাব দেন যে তিনি নিজের সঙ্গে নিজের একটি সাক্ষাৎকার তৈরি করুন যা তাঁর লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হবে । তাঁর পত্রিকায় প্রকাশিত সাক্ষাৎকারটি সাহিত্যিক মহলে অভাবনীয় সাড়া ফেলেছিল ।কারণ এই ধরণের সাক্ষাৎকার বাংলা সাহিত্যে এই প্রথম । সে-কারণে ২০০৪ সালের কলকাতা লিটল ম্যাগাজিন মেলায় তিনি এটি গ্রন্হাকারে প্রকাশ করেন । এখানে সম্পূর্ণ সাক্ষাৎকারটি তুলে দেয়া হল ।

প্রশ্ন: তুমি তো বহু সাহিত্য পত্রিকায় ইনটারভিউ দিয়েছ । হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে দিয়েছ । বহির্বাংলার বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে দিয়েছ। পোস্টমডার্ন সাহিত্যভাবনা সম্পর্কে দিয়েছ । ইংরেজি আর হিন্দি পত্রিকায় দিয়েছ । চাকরি পাবার জন্যে, চাকরিতে পদোন্নতির জন্যে দিয়েছ । তাছাড়া তুমি স্বদেশ সেন, কার্তিক লাহিড়ি, দীপঙ্কর দত্ত আর সুবিমল বসাকের সাক্ষাৎকার নিয়েছ । যখন তুমি রায়বরেলি গ্রামীণ ব্যাঙ্ক আর ফয়জাবাদ গ্রামীণ ব্যাঙ্কের ডায়রেক্টর ছিলে, তখন তুমি ক্লার্ক আর অফিসার পদে কর্মী নিয়োগের ইন্টারভিউ নিতে । সাক্ষাৎকার দেবার আর নেবার বহুস্তরীয় অভিজ্ঞতা তোমার হয়েছে । এখন কেউ যদি তোমাকে বলেন যে তুমি নিজের একটা সাক্ষাৎকার নাও, কিংবা তুমি নিজেকে একটা ইন্টারভিউ দাও, তাহলে তোমার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া কেমন হবে? তোমার মনের মধ্যে যা ঘটতে থাকবে, তা তুমি কীভাবে সামাল দেবে ?

উত্তর: বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় দেয়া সাক্ষাৎকারগুলো, যিনি বা যাঁরা সাক্ষা৭কারগুলো নিয়েছেন, তা একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গীর সমর্থন যোগাবার জন্যে নেওয়া, বিশেষ করে হাংরি আন্দোলন নিয়ে যে সাক্ষাৎকারগুলো তরুণ কবি-সাহিত্যিকরা নিয়েছেন, সেগুলো । প্রায় সবই মোটিভেটেদ । সকলেই মোটামুটি একটা হাংরি ইমেজ নির্মাণ বা অবিনির্মাণের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করেছেন । হাংরি আন্দোলনের সময়ে রচিত আমার লেখাপত্র সম্পর্কে কোনোও বিশ্লেষণভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করেননি তাঁরা । অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁরা সাক্ষাৎকার নেবার জন্যে আমার বইটই পড়ে নিজেদের প্রস্তুত করেননি । আমার ডিসকোর্সের পরিবর্তে, সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীরা নিজেদের ডিসকোর্সকে জায়গা করে দিতে চেয়েছেন ।ম পোস্টমডার্ন ভাবনা নিয়ে যাঁরা সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, তাঁরা বিষয়টি জানার জন্যে, এবং পাঠকদের সঙ্গে বিষয়টির পরিচয় করাবার জন্যে নিয়েছেন । সাকআৎকার কীভাবে নেয়া উচিত, তা স্পষ্ট করে দেবার জন্যেই আমি কয়েকজনের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলুম । তবে, বহুল-প্রচারিতদের সাক্ষাৎকার আমি নিইনি, কেননা তাঁরা মিথ্যায় গড়া সাবজেক্ট-পজিশানের কারবার করেন । গ্রামীণ ব্যাঙ্ক দুটোর কর্মী নিয়োগের জন্যে ইন্টারভিউ নেবার জন্যে আমায় নিজেকে পড়াশুনা করে যোগ্য করে তুলতে হয়েছিল । এখন তুমি যেই বললে নিজেই নিজের সাক্ষাৎকার নেবার কথা, আমার মনে হল, ব্যাপারটা অ্যাবসার্ড, কেননা যে নিচ্ছে তার এবং যে দিচ্ছে তার, এই স্হিতিটা তো দুটি সাবজেক্ট পোজিশানের বাইনারি অপোজিট নয় । একাধিক সাবজেক্ট পোজিশান রয়েছে, এবং প্রতিনিয়ত গড়ে উঠছে, যে-অবস্হায় এক্সটেমপোর জিনিস বেরোতে পারে বলে মনে হয় না । ব্যাপারটা আমার কাছে ওই সাবজেক্ট পোজিশানগুলোর ওপনিং আপ প্রক্রয়া হয়ে দাঁড়াচ্ছে । সমস্যা হল যে, এই ওপনিং আপ তো বিশাল, তাকে তো কিছুক্ষণ বা কয়েকদিনের চিন্তা পরিসরে ছকে ফেলা যাবে না । তার ওপর, যাকে দ্বিপাক্ষিক ডিসকোর্স হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে, তার মধ্যে দুটি পক্ষই এমনভাবে গড়ে উঠতে পরে যে, সাক্ষাৎকারের বদলে তা হয়ে দাঁড়াবে আত্ম-বিশ্লেষণ । ফলে সাক্ষাৎকারের genreটাকে subvert করে ফেলা হবে । তার মানে, একটা formless সাহিত্য-সংরূপ চাগিয়ে উঠবে, যাকে define করা কঠিন । বিজ্ঞানী মণি ভৌমিক যাকে বলেছেন বুদ্ধিমত্তার manifest শেষাবধি সেরকম একটা আদল-আদরা পাবে ।Syncretism দিয়ে সামাল দিতে হবে, যে প্রক্রিয়ায় জীবনের সবকিছু সামাল দিচ্ছি ।

প্রশ্ন: মাঝে-মাঝে অফিসের কাজে তুমি মুম্বাই থেকে পশ্চিমবাংলায় আসতে । পঁয়ত্রিশ বছর পরে পাকাপাকি কলকাতায় থাকতে এসে তোমার মনখারাপ হয়ে গেল কেন? তোমার আত্মীয় পরিজন, সাবর্ণ চৌধুরী ক্ল্যান, বন্ধুবান্ধব, সবায়ের সঙ্গে আবার দাখাসাক্ষাৎ হল, পাণিহাটি-কোন্নোগর-উত্তরপাড়ার কৈশোরের সঙ্গীসাথিদের সঙ্গে দেখা হল, তা সত্বেও তোমার মন কেন পীড়িত বোধ করতে লাগল ? মনে হল যে তোমার মস্তিষ্কের মধ্যে আবাল্য লালিত দেশের বাড়িতে তুমি ফেরোনি ?যেখানে ফিরেছ, তা অন্য ভূখণ্ড ? যাদের মাঝে ফিরেছ, তারা সম্পূর্ণ অন্য লোক ? যা লাগবে বলবেন কাব্যগ্রন্হে তুমি এই মননস্হিতি আর্টিকুলেট করলে, কিন্তু বুঝতে পারলে যে, যাদের পক্ষে ওই পাঠকৃতি প্রবেশযোগ্য ছিল, সেই আদি ভূমিজ পশ্চিমবঙ্গবাসী নিশ্চিহ্ণ হয়ে গেছে ? এই পীড়া তো নিরাময়ের অতীত ! কী করবে তুমি?

উত্তর: আমার এই দেশাত্মবোধ এতই বিমূর্ত আর জটিল যে, অনেক সময়ে আমার মনে হয়, আমার পীড়া আমারই সৃষ্ট । এ-জিনিসটা দেখনসই বাঙালিয়ানা নয় । কিংবা এমনটাও নয় যা আমার আত্মীয়-জ্ঞাতিরা বলে থাকেন, যে, রিফিউজিরা এসে আমাদের পশ্চিমবাংলাকে ধ্বংস করে দিলে । বস্তুত অন্য শব্দ না পেয়ে আমি দেশাত্মবোধ শব্দটা প্রয়োগ করছি । পাকাপাকি ফিরে আসার পর, মাঝেমধ্যে ছেলের কাছে মুম্বাইতে বা মেয়ের কাছে আহমেদাবাদে যাই, আমি বুঝতে পারি, আমি এই পীড়া নিজের সঙ্গে নিয়ে বেড়াই । জলাঞ্জলি উপন্যাসের শেষার্ধে এবং নামগন্ধ উপন্যাসে ধরার চেষ্টা করেছিলুম, কিন্তু বোধটা এমনই অ্যাবসট্র্যাক্ট যে অনায়ত্ত রয়ে গেল । ব্যাপারটা পারক্য, এলিয়েনেশন, একাকীত্ব, মন ভালো নেই ধাঁচের নয় । অ্যানুই নয় । একে শেয়ারও করা যায় না । আমার মনে হয় মুম্বাই থেকে মাঝে-মধ্যে পশ্চিমবাংলায় অফিসের কাজে আসার সময়ে আমি এই পীঢ়া-বোধটা পিক আপ করেছি । বাঙালির সঙ্গে বাঙালি মন খুলে কথা বলে না টের পাবার পর আমি এম আর চোওধারি হয়ে হিন্দি আর ইংরেজিতে কথা বলতুম । মুর্শিদাবাদ-মালদা জেলায় উর্দুভাষী মুসলমানের মতন কথা বলেছি । দাড়ি রাখার সূত্রপাত এই ক্যামোফ্লেজের প্রয়োজন মেটাতে । সাহিত্যিকদের সঙ্গে পারতপক্ষে মেলামেশা করতুম না । কেউ আমায় চিনত না বলে অসুবিধা হয়নি । এলডিবির ম্যানেজিং ডায়রেক্টর প্রত্যুষপ্রসূন ঘোষ আমার পাশে বসে সরকারি মিটিঙেও জানতে পারেননি । আর কোনও কবি বা লেখক এই পীড়ায় আক্রান্ত কি না জানি না । এ কোনোও অসুখ নয় । একজনকে গভীর ভালোবাসতুম, অথচ এখন দেখে আর তার সঙ্গে বাস করে, বুঝতে পারছি না সে-ই কি না, অথচ তার কাছেই তো এসেছি । বাইরে না গিয়ে টানা এখানে থেকে গেলে এরকমটা হতো না হয়তো । যাঁরা সেই তখন থেকে পশ্চিমবাংলার সাথাসাথা মেটামরফোজড হয়েছেন, বা মেটামরফোসিস প্রক্রিয়াটিতে যাঁদের অবদান রয়েছে, তাঁদের এই পীড়ার বোধটা জন্মায়নি । না লেখকদের, না আলোচকদের । আমার তাই সন্দেহ থেকে যায় যে আমার পাঠকৃতি আর পাঠক-আলোচকদের মাঝে ওই পীড়া একটা অনচ্ছ দেয়াল হয়ে দাঁড়াচ্ছে না তো ? কেননা, এমনিতেই আমার পাঠকৃতির আগেই আমার ইমেজ---কালীকৃষ্ণ গুহের কাছে একরকম, অনিকেত পাত্রের কাছে একরকম, আবার নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কাছে আরেকরকম---পাঠকের কাছে পৌঁছে ভ্যারিয়েবল ইন্টারপ্রিটেশনের সম্ভাবনা গড়ে ফ্যালে, যা আসলে পাঠকের নিজের চাহিদা মেটাবার জন্যে । পাঠকৃতির উদ্দেশে নয় । সম্ভবত গ্রহণ-বর্জনের বৈভিন্ন্যের নিরন্তর টানাপোড়েনে পাঠকৃতি-বিশেষ তার নিজের পরিসর অহরহ গড়ে নিতে থাকে । তার কিনারায় গালে হাত রেখে বসে থাকা ছাড়া আমের কিছু করার নেই ।

প্রশ্ন: তুমি তোমার কবিতা অনুশীলনে ফর্ম, কনটেন্ট, মিঊজিকালিটি এসব নিয়ে প্রথম থেকেই ভেবেছ কী? এগুলো আলাদা-আলাদা ভেবেছ কী ? নাকি একটা কবিতাকে এককসমগ্র উৎসার ভেবে ঠিক সেভাবেই গড়ে উঠতে দিয়েছ? প্রশ্নটা এই জন্যে করতে হল যে একটা একঘেয়ে আদল না থাকলে সেই কবির কাজগুলোর একঘেয়েমির ছাপ পাঠকের মগজে বসতে পারে না বলে পাঠক তোমার কাব্যজগত সম্পর্কে পাকাপাকি ধারণা তৈরি করার বদলে কনফিউজড হয়ে যান । রবীন্দ্রনাথ, মোহিতলাল মজুমদার, নজরুল, বিষ্ণু দে, সমর সেন, আলোক সরকার, যাঁর কবিতার দিকে তাকাও, দেখবে যে তাঁরা অনুশীলনের মাধ্যমে নিজস্ব একঘেয়েমি গড়ে তুলেছেন যার ছাঁচে তাঁদের যে কোনোও কাব্যিক ডিসকোর্স ঢালাই করে দিয়েছেন । অথচ তোমার প্রথম কাব্যগ্রন্হ শয়তানের মুখ থেকে দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্হ জখম একেবারে আলাদা । তারপর প্রকাশিত হল মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর যার সঙ্গে সামান্যতম মিল নেই জখম কাব্যগ্রন্হের । এরপর বেরোল হাততালি, যা সম্পূর্ণ ভিন্ন মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর বইটার কবিতাগুলো থেকে । তোমার সাম্প্রতিক কৌণপের লুচিমাংস পর্যন্ত এই ব্যাপারটা লক্ষ করা গেছে । সাহিত্যের ইতিহাসে জায়গা দখলের জন্যে প্রধান ব্যাপার হল একঘেয়েমি, যাকে ইউরোপে বলা হয়েছে কবির মৌলিক শৈলী । সর্বজনস্বীকৃত সেই পথ অগ্রাহ্য করে তুমি ভুল করে যাচ্ছ না কি ?

উত্তর: ক্লাস নাইনে পড়ার সময়ে আমাদের সংস্কৃত শিক্ষক বলেছিলেন, "আরে ইংরেজদের বুকে অত দম আছে নাকি যে বেদ-উপনিষদের মতন শ্লোক লিখবে বা গীতা মতন কাব্য লিখবে ? শিতের দেশের লোক, চান-টান করে না, একটুতেই দম ফুরিয়ে যায় বলে অমন কবিতা লেখে, যেন ছুটতে ছুটতে দম নিচ্ছে ।" কালিদাসের আড়াল নিয়ে তুমুল আক্রমণ করতেন টেনিসন, কীটস, শেলি প্রমুখকে । তখন অত না বুঝলেও, ব্যাপারটা আমার মাথায় থেকে গিয়েছিল । যখন কবিতা লেখা আরম্ভ করলুম, গোগ্রাস বইপোকা ছিলুম বলে, য়েশ পড়াশোনা করে ফেলতে পেরেছিলুম যাতে পয়ার ফাটিয়ে বেরোতে পারি । আমার মনে হয়, কবিতায় একঘেয়েমি বজায় রাখার জণভে একটা টিপিকাল বাল্যকালীন আত্মপরিচিতির সঙ্গীতজগত দরকার হয়, যা অগ্রজ বাঠালি কবিদের মতন আমার ছিল না । দাদারও ঝর্ণার পাশে শুয়ে আছি, জানোয়ার এবং আমার ভিয়েতনাম কাব্যগ্রন্হ তিনটের মধ্যে একঘেয়েমির মিল নেই, যা দাদার বন্ধু দীপক মজুমদার, আনন্দ বাগচী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপধ্যায় প্রমুখের কবিতায় আছে । বিহারিপাড়ার অন্ত্যজ লোকসঙ্গীত, শিয়া মুসলমানদের গজল, নাথ, কাওয়ালি, মিশনারি স্কুলে চার্চ কয়্যার, রামমোহন রায় সেমিনারিতে ব্রাহ্মসংগীত, বাবার দোকানের কর্মী ডাবরের রহিম-দাদু-কবীর, বাড়ির কাজের লোক শিউনন্নির রামচরিতমানস, বঢ়জ্যাঠার আঙুরবালা-শু্ভলক্ষ্মী, বড়দি-ছোড়দির খেয়াল-ঠুমরি, জ্যাঠাইমার নানারকম পাঁচালিগান, সতীশকাকার চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে মন্ত্রৌচ্চারণ, এই পলিমরফাস মিউজিকালিটিতে আমার বাল্যকাল কেটেছে । এই অধম ওই অধম উপন্যাসে আর ছোটোলোকের ছোটোবেলা স্মৃতিকথায় আমি ব্যাপারটাকে চেহারা দেবার চেষ্টা করেছি । একটা পলিসোনিক পরিমণ্ডলে বড় হওয়ায় এক কাব্যগ্রন্হ থেকে পরের গ্রন্হে পরিবর্তনটা মনে হয়েছে অপরিহার্য । তা নইলে একটা নতুন বই বের করার দরকারটাই বা কী? পাঠক নামক একজন অপরকে সামনে দাঁড় করিয়ে, নিজের কাব্য টেক্সটের দশহাজার কিলোর একঘেয়ে হাতুড়ি ঠুকে যাচ্ছি বছরের পর বছর, ওটা আমার ভাষা-প্রযুক্তির অন্তর্গত ছিল না কখনও । কবিতা পড়তে শুরু করে বিষ্ণু দে, সমর সেন প্রমুখের ভাষা-স্ট্রাকচারকে মনে হয়েছিল আউট অ্যান্ড আউট বুর্জোয়া । ভিরমি খেয়েছিলুম দাদার কাছে শুনে যে ওনারা মার্কসবাদী । তারপর তো নকশাল কবিদের দেখলুম যারা কবিতা লিখেছেন কুলাক-বাড়ির ভাষায় । আসলে সবাই ভেবেছেন কী বলছেন সেটাই গুরুত্বপূর্ণ । তাই যদি হবে, তো কবিতা লেখা কেন? অদ্বয়বজ্র, ক্রমদীশ্বর, ইন্দ্র্যভূতি, অতীশ দীপঙ্কর, চৈতন্যদেব প্রমুখ বাঙালিরা তো ওসব বলে গেছেন বহুকাল আগে । বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সম্পর্কে জ্যোতি বসু একবার বলেছিলেন, "ও ওইসব কালচার-ফালচার নিয়ে থাকে ।" কথাটা আমায় স্ট্রাইক করেছিল । বঙ্গসংস্কৃতির দুটো বর্গ আছে । রবীন্দ্রনাথ থেকে শঙ্খ ঘোষ হয়ে হাল আমলের বহু কবি হলেন কালচারের মানুষ, যাঁদের কবিতায় একঘেয়েমিটা কালচার দ্বারা নির্মিত । আমি আর আমার মতন কেউ-কেউ হলেন ফালচার বর্গের মানুষ, যাঁরা একঘেয়েমি না কাটাতে পারলে পাগল হয়ে যাবেন । ফালচার বলতে আমি ছোটোলোকের ছোটোবেলা স্পেসটার কথা কেবল বলছি না । আমাদের বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ নিষিদ্ধ ছিলেন ব্রাহ্ম বলে । পিরিলি বাউনদের বজরা উত্তরপাড়ার গঙ্গায় ভাসলে স্নান অর্ধসমাপ্ত রেখে ঠাকুমার পাল্কি ফিরে আসত । সিনেমা দেখা নিষিদ্ধ ছিল কেননা তা লোচ্চাদের তামাসবিনি । অথচ পাশাপাশি মিশনারি স্কুল আর ব্রাহ্ম স্কুলও ঘটেছে । এই ইরর‌শানালিটি দিয়ে ডিফাইন করতে হবে ফালচার ব্যাপারটাকে । নিজেরা ফালচার বর্গের হয়েও আমি আর দাদা যে লেখালিখি আরম্ভ করলুম, তার কারণ অবশ্য মামার বাড়ির উচ্চমধ্যবিত্ত কালচার । ফালচারজগৎ এবং কালচারজগতের মাঝে যোগসূত্র ছিলেন শৈশবে পিতৃহীন আমার মা । আমি তো আর কোনো কবি-লেখকের কথা জানিনা, যাঁর সাবজেক্ট পোজিশানগুলো এরকম স্পেস আর টাইমে গড়ে উঠেছে । কালচার এমনই এক বাঙালিয়ানা যে-পরিসরে কখনও তুর্কি, কখনও ইরানি, কখনও ব্রিটিশ, কখনও সোভিয়েত, কখনও মারোয়াড়ি তাপের আঁচ কাজ করে গেছে বলে তা বেশ সুশৃঙ্খল । ফালচার জায়গাটার লোকটা বাঙালি বলে তার বিশৃঙ্খলা দিয়ে বাঙালিয়ানা সংজ্ঞায়িত; কোনোও সুনির্দিষ্ট অপরিবর্তনীয় সীমানা নেই । আমার ফিকশানে বহু চরিত্রের নির্গুণ বৈশিষ্ট্য এই সীমাহীনতার বোধ থেকে এসেছে । আমাদের উত্তরপাড়ার বাড়িটা শুনেছিলুম কোনও তুর্কি স্হপতির নকশা অনুযায়ী তৈরি, ইজিয়ান সমুদ্রের পূর্বপাড়ের ভিলাগুলোর আদলে; তিনশ বছর আগে বাড়ির সামনে দিয়ে গঙ্গা বইত । বাড়িটায় পঞ্চমুণ্ডের আসন ছিল; আর সেই জায়গাটায় বসে ছোটোবেলায় বেশ ফালচারি ফিল নেয়া যেত । সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত প্রমুখের সাইকিতে এরকম প্রাক-ঔপনিবেশিক সাবটেরানিয়ান এথনিক বাঙালিয়ানা সম্ভব কি? এই সাবভারসিভ ফালচার? নেই, সম্ভব নয় । তাঁরা সমন্বিত চেতনার ইউনিফায়েড সেল্ফের বাইরে বেরোতে অপারগ । তান্ত্রিক নকশা-আঁকা লাল সিমেন্টের চারকোণা জায়গায় স্রেফ কিছুক্ষণ অন্ধকারে বসে থেকে যে নানা সাবজেক্ট পোজিশান স্পষ্ট হয়, ভয়ের, অতীতের, শবের, ধর্মের, নেশার, তন্ত্র নামক অনচ্ছ ধারণার, যৌনতার, এবং এ-ধরণের পাঁচমেশালি ফালচারি পরিচিতি, তা থেকেই তো জেনে গিয়েছিলুম যে শৈলীর একঘেয়েমি চলবে না । একটা বইয়ের সঙ্গে আমার আত্মীয়তা পুরোনো হয়ে গেলে পরের বইতে যেন বোঝা যায় যে দুটি কাব্যগ্রন্হের মাঝে এক বা একাধিক সাইকো-লিংগুইস্টিক রাপচার্স ঘটে গেছে । আমার সাইকো-লিংগুইস্টিক স্পেসটাও মাইগ্রান্ট, কিন্তু সে মাইগ্রান্সি দেশভাগোত্তর রিফিউজি পরিবারের কবি-লেখকদের থেকে ভিন্ন, কেননা আমার মধ্যে রিরুটিঙের উদ্বেগ ছিল না, নেই । আমার মাইগ্রান্সি বজায় আছে । রিরুটিং পাকা হতেই রিফিউজি পরিবারের কবির মাইগ্রান্সি হাপিস, এবং তাঁরা একঘেয়েমির খপ্পরে । মনে হয় যে একঘেয়েমির ছকে পড়ে গেলে আমার কবিতা লেখা ফুরিয়ে যাবে । কবিতা লেখা বেশ কমে এসেছে । পত্রিকাগুলো চায়, কিন্তু ছকের মধ্যে থেকে যাচ্ছে বলে বাতিল করে দিতে হচ্ছে । একইরকম কবিতা অনেকে হুহু করে দিনের পর দিন কীভাবে লিখে যান, কে জানে! অধিকাংশ বিদ্যায়তনিক আলোচক এখনও ইউরোপে উনিশ শতকে শেখানো লেখককেন্দ্রিক আলোচনাপদ্ধতিতে আটক, আর কেবল সময় সময় সময় সময় বকে যান । আলোচনা যে পাঠবস্তুকেন্দ্রিক হওয়া উচিত, স্পেস স্পেস স্পেসের ভাবনা ভাবা দরকার, তা এখনও খেয়াল করে উঠতে পারেননি আলোচকরা । এখনও তাঁরা ইউরোপীয় অধিবিদ্যার মননবিশ্বের কারাগারে নিজেরা নিজেদের পায়ে বেড়ি হাতে হাতকড়া পরিয়ে রেখেছেন ।

প্রশ্ন: রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও অশ্লীলতা , এই দুটি ধারায় তুমি গ্রেপ্তার হয়েছিলে । তোমাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল সেপ্টেম্বর ১৯৬৪তে । তোমাকে চার্জশিট দেয়া হল আর তোমার বিরুদ্ধে মকদ্দমা আরম্ভ হল মে ১৯৬৫তে । এই নয় মাস কলকাতার মিডিয়া আর কফিহাউস-বুদ্ধিজীবিরা অবিরাম প্রচার চালিয়েছিলেন যে তোমার বিরুদ্ধে অশ্লীলতা বা পোরনোপুস্তক লেখার অভিযোগ উঠেছে । তুমি যে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, সে খবর মিডিয়া বেমালুম চেপে গিয়েছিল ওই নয় মাস । বিদ্ধদেব বসু এবং সমরেশ বসুর বিরুদ্ধে যে মকদ্দমা হয়েছিল, ওনাদের বিরুদ্ধে কিন্তু রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ ছিল না । তোমার বিরুদ্ধে সিরিয়াস অভিযোগ ছিল বলে তোমাকে আর তোমার দাদাকে জেরা করেছিল একটা ইনভেস্টিগেটিং বোর্ড যাতে সদস্য ছিলেন পুলিস, সেনা, স্বরাষ্ট্র বিভাগ, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা দপতরের উচ্চপদস্হ আধিকারিকরা । মামলা রুজু হতে তুমি দেখলে যে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে নেয়া হয়েছে, এবং চার্জশিট দেওয়া হয়েছে অশ্লীল কবিতা লেখার ধারায় । রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে নায়া হয়েছে দেখে তোমার মনখারাপ হয়ে গিয়েছিল কেন? এ-রাষ্ট্র তো ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত সরকার নয় যে তুমি রাষ্ট্রদ্রোহিতা করে গর্ববোধ করবে ? তোমার নিজেরই স্বদেশী উত্তরঔপনিবেশিক সরকার ! তোমার তো ভারমুক্ত বোধ করা উচিত ছিল । পরিবর্তে তুমি বিষণ্ণ হলে ?

উত্তর: স্বাধীনতা লাভের পর একজন কবির বিরুদ্ধে প্রথম রাষ্ট্রবিরোধী কাজের অভিযোগ তোলা হল । সারা ভারতবর্ষে প্রথম । কেবল কবিতা বা গল্প নিয়ে নয়, আমি রাজনীতি আর ধর্ম নিয়েও ম্যানিফেস্টো বের করেছিলুম, যা কোনও বাঙালি কবি তার আগে করেননি । ফলে রাষ্ট্রের টনক নড়ে গেল । রাষ্ট্র তো একটা অ্যাবসট্র্যাক্ট সিস্টেম, যেটা চালায় একদল লোক । সেই লোকগুলো, যারা যখন মসনদে বসে, নিজেদের রাষ্ট্র বলে মনে করে । রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলতে প্রখৃত পক্ষে বোঝায় মসনদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র । যারা মসনদে বসে, তারা সবসময়ে পায়া টলে যাবার আতঙ্কে ভোগে । মসনদ বিরোধিতাই হল এসটাবলিশমেন্ট বিরোধিতা । আমি তো স্বঘোষিত এসটাবলিশমেন্ট বিরোধী । অভিযোগটা ছিল তার স্বীকৃতি । তাই মন খারাপ লেগেছিল । আসলে আঘাতটা যাঁদের দিয়েছিলুম, সেই সব মন্ত্রী, প্রশাসনিক আমলা আর পুলিসের কর্তারা বুঝতে পেরেছিলেন যে, অভোযোগের প্রমাণ যখন আদালতে পেশ হবে, তখন সাধারণ মানুষ তাঁদের নিয়ে হাসিঠাট্টা করবে । মসনদের কেদারায় আসীন লোকগুলোর মগজে আমি অস্হিরতার বোধ চালান করে দিয়েছিলুম, তাঁদের আত্ম্ভরী ক্ষমতায় ঘা মেরে, মুখ্য ও অন্যান্য মন্ত্রী, মুখ্য ও অন্যান্য সচিব, জেলাশাসক, পুলিশের কমিশনার ও আই জি, সংবাদপত্রের সম্পাদক ও বুদ্ধিজীবীদের কাগজের মুখোশ পাঠিয়ে, রাক্ষস-অসুর-জানোয়ার-জোকার-মিকিমাউসের মুখোশ পাঠিয়ে, যার ওপর ছাপিয়েছিলুম একটি বার্তা: দয়া করে মুখোশ খুলে ফেলুন । প্রশাসনের ক্রুদ্ধ নি-জার্ক প্রতিক্রিয়ার কথা পুলিশ কমিশনার নিজে আমাকে আর দাদাকে বলেছিলেন । এখন তো বিরোধীপক্ষের লোকেরা প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীকে বলছে মুখৌটা বা মুখৌশধারী, বলছে মুখোশ খুলে ফেলুন । অনেকে তখন হ্যা হ্যা হি হি করেছিলেন, কেননা তাঁরা টের পাননি যে এসটাবলিশমেন্টের দাঁতকে শক্ত আর নখকে তারাল করে রেখে গেছে ইংরেজরা । তাঁরা হাড়ে হাড়ে টের পেলেন যখন নকশালর আন্দোলনে অংশ নেয়ায় অত্যাচারিত হলেন ও গুমখুন হলেন কবি ও লেখকরা । আরও বেশি করে টের পেলেন এমার্জেন্সির সময়ে যখন পচা আলুর চটের বস্তার মতন জেলের ভেতর নিক্ষিপ্ত হলেন লেখক ও সাংবাদিকরা, আর অশিক্ষিত লোকেদের দ্বারা প্রকাশিতব্য পাঠবস্তু অনুমোদন করাতে হল, কারা গারে দাগি আসামির মতন দাড়ি বাড়াতে হল গৌরকিশোর ঘোষকে, পালাতে গিয়ে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে ঠ্যাং ভাঙলেন জ্যোতির্ময় দত্ত।মুখোশধারী অ্যাবসট্র্যাক্ট সিস্টেম যে একই আছে, তা অভিজিৎ সিংহের আত্মহত্যায় আবার প্রমাণিত হল চল্লিশ বছর পর । তাত্বিক বিপ্লব আজকের দিনে বুদ্ধিবৃত্তির ভাঁোতামাত্র জেনেও, অ্যাবসট্র্যাক্ট সিস্টেমের নি-জার্ক প্রতিক্রিয়া যে একই আছে, তা টের পাওয়া যায় মসনদের আতঙ্কবোধ থেকে, যখন তা কচি কচি ছেলেমেয়েদের এসটাবলিশমেন্ট বিরোধিতাকে ভয় পেয়ে মাঝরাতে তুলে নিয়ে গিয়ে নখদন্ত দেখায় । পচনের এই প্রক্রিয়াকে আমি কিছিটা ধরার চেষ্টা করেছি নখদন্ত সাতকাহনে । বাঙালদের যে নেতারা ১৯৫০ সালে সংবিধান পুড়িয়েছিল, আজ তাদের কুর্সি নড়বড় করছে মনে হলেই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের ধুয়ো তোলে । নবদ্বীপের গাণ্ডীব পত্রিকায় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র কনসেপ্টটাকে রিডিকিউল করে টুসকি অবিনির্মাণ শিরোনাঞে একটা পোস্টমডার্ন ছোটগল্প লিখেছি ।

প্রশ্ন: তোমার প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার কবিতার বিরুদ্ধে হাংরি আন্দোলনের সময়ে অশ্লীলতার আরোপে মামলা হয়েছিল । সাহিত্যে অশ্লীলতা তখন নেতিবাচক ছিল । তোমার লেখালিখিতে অত্যধিক যৌনতা থাকার অভিযোগও উঠেছে । তোমার লেখালিখির জন্যেই তো হাংরি আন্দোলনকে অনেকে বলতেন যৌন ক্ষুধার আন্দোলন । তোমার নান্দনিক অবস্হান আর নৈতিকতা নিয়ে এরকম নেতিবাচক মন্তব্য সত্ত্বেও তুমি মনে-মনে আনন্দ পেয়েছ । সমাজকর্তারা, সাহিত্যবেত্তারা, তোমার পাঠকৃতিকে অশ্লীল বললেন, যৌনতার বাড়াবাড়ি বললেন, ইমমরাল বললেন, অথচ গোপনে-গোপনে সে-কারণে তুমি গর্ববোধ করলে ! এটা পারভার্সান ছাড়া কী?

উত্তর: ব্রাহ্ম স্কুলে ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল পাঠ্য ছিল । বাংলার শিক্ষক অধিকারীবাবু একদিন সিলেবাসের বাইরে বেরিয়ে জানিয়েছিলেন, অন্নদামঙ্গল, বিদ্যাসুন্দর-এর কোন অংশগুলোকে বঙ্কিমচন্দ্র, রমেশচন্দ্র দত্ত, দীনেশচন্দ্র সেন, রবীন্দ্রনাথ, জেমস লঙ প্রমুখ অশ্লীল ঘোষণা করেছেন । উনি ভারতচন্দ্রকে ডিফেন্ড করে ব্রাহ্ম এলিটিজমকে আক্রমণ করেন, যা প্রধানশিক্ষকের কানে পৌঁছোলে অধিকারীবাবুকে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল । আমি ভারতচন্দ্রের পক্ষে চলে গিয়েছিলুম অন্নদামঙ্গল-এর তৃতীয় অংশ মানসিংহ-ভবানন্দ উপাখ্যান পড়ার সময়ে, কেননা আমার পূর্বজ লক্ষ্মীকান্ত রায়চৌধুরী ছিলেন প্রতাপাদিত্যের প্রধান অমাত্য । আমার লেখায় যৌনতা আরোপিত নয় । কিন্তু অশ্লীলতা-যৌনতার অভিযোগে আমি ভারতচন্দ্রের ডিসকোর্সের পরিসরটা, যা এখন বুঝতে পারি প্রাগাধুনিক-প্রাকঔপনিবেশিক বলে, রিগেইন করে নিতে পেরেছিলুম । ভারতচন্দ্র-এর রচনায় যৌনতাকে আক্রমণের সূচনা করেছিল ব্রিটিশ অধ্যাপকরা । আর সাবর্ণ চৌধুরীরা গরিব হয়ে গিয়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রথম সাম্রাজ্যবাদী ধাক্কায়, যখন ওরা কলকাতা-সুতানুটি-গোবিন্দপুর নিয়ে নিল । আমার মধ্যে, অভিযোগগুলো শুনে, বদলা নেবার গোপন গর্ববোধ চাগিয়েছিল । পার্ভারসান যে মনে হয় না, তারও কারণ আছে । বড়জ্যাঠা পাটনা মিউজিয়ামে কিপার অব পেইনটিংস অ্যান্ড স্কাল্পচার ছিলেন । পরীক্ষা-পরবর্তী স্কুলছুটিতে ওনার সাইকেলের কেরিয়ারে বসে প্রায়ই পাটনা মিউজিয়ামে যেতুম। স্কাল্পচার বিভাগে নানা ঢঙের নগ্ন-ন্গিকা অবাধে দেখে বেড়াতুম । দেখতুম যে পুরুষরা খাঁজকাটা যোনি বা স্তনের বোঁটায় টুক করে হাত দিয়ে নিচ্ছে বা ঠোঁট ঠেকাচ্ছে । মেয়েরা একই ব্যাপার করছে গ্রিক পুরুষের লিঙ্গ নিয়ে । হাত ঠেকিয়ে, চুমু খেয়ে সেসব অংশগুলোকে একেবারে চকচকে করেদিয়েছিল দর্শনার্থীরা । এখন মিউজিয়ামে নানা নিষেরধ হয়েছে যা তখন ছিল না । আমি প্রতাপাদিত্যের চেয়ে প্রাচীন সময়ে চলে যেতুম, যখন মেগাসথিনিস কয়েক হাজার গ্রিক তরুণী এনে পাটনায় তখনকার ক্ষমতাসীনদের বিলিয়েছিলেন, কিংবা যখন গ্রিক সম্রাট মিনান্ডার পাটনা শহরে আগুন ধরিয়ে লন্ডভন্ড করার পর অনুতপ্ত হয়ে বৌদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন । অতীতের সঙ্গে আমার যা যোগসূত্র, আমি জানতুম, জানি, অভোযোগকারীদের সেরকম যোগসূত্র নেই । আমার কাছে তারা সদ্যভূমিষ্ঠ । মিউজিয়ামে বড়জ্যাঠার অফিসঘরে একাধিক নিউড পেইনটিং ছিল, যার একটা আমার ঠাকুর্দা লক্ষ্মীনারায়ণ রায়চৌধুরীর আঁকা । ঠাকুর্দা ছবি আঁকা আর ফোটো তোলা শিখেছিলেন লাহোর মিউজিয়ামের কিউরেটর জন লকউড কিপলিঙের কাছে । ইনি সম্ভবত রাডিয়ার্ড কিপলিঙের বাবা, যাঁর সুপারিশে ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় কলকাতা মিউজিয়ামে সহকারী কিউরেটর হয়েছিলেন । ঠাকুর্দার আঙকা নিউডটা সম্পর্কে বড়জ্যাঠার গর্ববোধ ছিল । প্রত্যেক সদ্য-পরিচিতকে বলতেন ছবিটা ওনার বাবার আঙকা । ফলে আমার একটা ঐতিহাসিক সাপোর্ট সিস্টেম রয়েছে । হাংরি মকদ্দমার সময়ে বড়জ্যাঠা-বাবা-কাকারা আমায় টোটাল সাপোর্ট দিয়েছিলেন । বাবা তো পাটনা থেকে আদালতে এসেওছিলেন হিয়ারিঙের সময়ে বারকয়েক । আহিরিটোলা থেকে পিসেমশায়ও আসতেন ।

প্রশ্ন: তুমি তো রান্নাবান্না কর । সাধারণ বাঙালি রান্না রাঁধতে জান । অধিকাংশ কবি-লেখক যখন রান্না করা, বাসন মাজা, ঝুল ঝাড়া ইত্যাদি কাজকে অবমাননাকর মনে করেন, তখন তুমি রান্না-বান্নার কথা খোলাখুলি বলো কোন সাহসে? তাও আবার সংবাদপত্রের শৌখিন রান্না নয়, রোজকার রান্না । বিশুদ্ধ শিল্প, উত্তরণ, নান্দনিক বোধ ইত্যাদির প্রেক্ষিতে রান্নাবাড়ি ব্যাপারটা কি স্ববিরোধী নয় ? একদিন তুমি যখন ফ্যান গালছিলে, তখন মাঝি পত্রিকার সম্পাদক টেলিফোনে সেকথা শুনে স্তম্ভিত হয়েছিলেন, বিশ্বাস করতে পারেননি । নখদন্ত সাতকাহনের প্রতি পৃষ্ঠায় তোমার রান্নার রেফারেন্স আছে । ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস উপন্যাসে বিসদৃশ মেনু আছে । জলাঞ্জলি উপন্যাসে সেক্সুয়াল অ্যাক্ট বর্ণনা করেছ রান্না প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, আর তদ্বারা আক্রমণ করেছ সংবাদপত্রের শ্রখিন রন্ধনকর্মকে । নামগন্ধ উপন্যাসে রান্নাবান্নায় লুকিয়ে থাকা শ্রেণি বিভাজন অন্তত দুবার তুমি স্পষ্ট করেছ । তোমার কবিতাতেও রান্না বা কুইজিনের প্রসঙ্গ থাকে । তোমার আলোচকরা কেউই এই ব্যাপারটা ধরতে পারেননি দেখে তোমার অবাক লাগেনি? রান্না করতে শিখলে কোথায় ?

উত্তর: ইমলিতলায় হিন্দু-মুসলমান সবায়ের হেঁসেলে ঢোকার অবাধ অধিকার ছিল । রান্নাবাড়ির সাংস্কৃতিক পাথফক্যের ব্যাপারটা মগজে স্হান করে নিতে পেরেছিল । কুড়িজনের পরিবারে রান্নাঘরের ইনচার্জ ছিলেন মা। বাবা আর ছোটকাকা বিশুদ্ধ শাকাহারি ছিলেন । ইমলিতলার বাড়িতে কেবল পাঁঠার মাংস, হাঁসের ডিম, আঁশযুক্ত মাছ অনুমোদিত ছিল । প্রতি রবিবার ও ছুটির দিন বড়জ্যাঠা রাঁধতেন ওনার সাবর্ণ চৌধুরী স্পেশাল, যার তিনটে আমার স্মৃতিতে গেঁথে আছে । বাদাম কিসমিস খোয়াসহ যাবতীয় আনাজ দিয়ে সোনামুগ-আতপচালের মিষ্টি ভুনি খিচুড়ি; ঘিয়ে ভাজা তেতো-বর্জিত আনাজ দুধে সেদ্ধ করে ফোড়ন-তেজপাতার ওপর নারকোল কুরো দেয়া মিষ্টি শুক্তো; এবং বাঁধাকপি-ফুলকপি আলুতে ভেটকিটুকরো গরম মশলা দিয়ে মাখোমাখো তরকারি । ইমপ্রেশানিস্টিক মাইন্ড বলতে যা বোঝায়, তাতে এই পুরো সিনারিওটার ছাপ পড়েছে, যেটা ধরার কিছুটা চেষ্টা করেছি এই অথম ওই অধম উপন্যাসে আর ছোটোলোকের ছোটোবেলা স্মৃতিকথায় । দরিয়াপুরের বাড়িতে একা থাকতে গিয়ে যখন নিষেধ ভাঙার, সীমালঙ্ঘনের, যথেচ্ছাচারের পর্ব শুরু হল, তখন সহপাঠী তরুণ-বারীন-সুবর্ণর সঙ্গে যা ইচ্ছে খাওয়া আর রাঁধার স্বাধীনতা পেয়ে গেলুম । প্রতিবেশি এক মুসলমান চুড়িওয়ালা অনেক পদ রাঁধতে শিখিয়েছিল । আমার স্ত্রী বাড়িতে মারাঠি পদগুলোর অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে । লখনউতে দেড় বছর তেলেগু আবদুল করিম, পাঞ্জাবি মদন মোহন, কর্ণাটকি শেট্টিখেড়ে প্রভাকরা আর কোংকনিয় কুরকুটে একটা ফ্ল্যাটে ফোর্সড ব্যাচেলর হয়ে নিজেরা পালা করে রাঁধতুম । রান্না ব্যাপারটা যে যৌথজীবনে কত গুরুত্বপূর্ণ, এবং আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক জলবিভাজক, তা পিক আপ করেছি অভিজ্ঞতার বিভিন্ন স্তরে । বাঙালি লেখক-শিল্পীরা রান্নাকে ডিসকোর্স হিসেবে নেন না সম্ভবত উনিশ শতকের প্রধান পুরুষদের যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে, তার ফলে। তার ওপর শ্বেতাঙ্গ পিতৃতন্ত্রের যে আদল-আদরা ইংরেজরা আমাদের সাহিত্যে চাপিয়ে গেছে, তাকে ডিকলোনাইজ করার জন্যে আমার মনে হয়েছে রান্নাবান্নার ব্যাপারটা একটা প্রধান হাতিয়ার। দাদা অবশ্য আমার চে্যে ভাল আটপৌরে রান্না জানে, আর বাবার কাছে শাকসব্জি আনাজপাতির আয়ুর্বেদিক গুণাগুণ শেখার ফলে রান্নাবাড়ির বাঙালিয়ানা ঐতিহ্য ধরে রাখতে পেরেছে। ইমলিতলার রান্নাঘরে কোনবারে আর কোন তিথিতে কী-কী খেতে নেই, তার তালিকা থাকত, আগের বছরের পাঁজির ছেঁড়া পাতা । রান্না ব্যাপারটায় জীবনের সবকিছুই তো আছে ইনক্লুডিং সেক্স । আলোচকদের চোখে পড়েনি তার কারণ তাঁরা কেবল খাবার মধ্যে আটক, তার আগের পর্বের কর্মকান্ডেই যে তাঁদের সমাজটির নিবাস, তা অনুভব করেননি । বুদ্ধিজীবী যদি মাল্টিডিসিপ্লিনারি না হয়, তাহলে সাহিত্যের পুরো এলাকাটা খণ্ডিত করে ফ্যালে ।

প্রশ্ন: পোখরানে আনবিক বোমা ফাটাবার পর অনেক প্রতিবাদ হল, কবিতা লেখালিখি হল, গলা-কাঁপানো বক্তৃতা হল । এবারেই বেশি হল । প্রথমবার যখন ফাটানো হয়েছিল, তখন এতটা চেঁচামেচি হবনি । তুমি কেন আর সবায়ের মতন এর বিরুদ্ধে পদ্য বা গদ্য লিখলে না? ক্যাসেট বের করলে না? প্রথমবারও করোনি । এবারও করোনি। তুমি কি প্রসঙ্গটা থেকে কূটনৈতিক দূরত্ব বজায় রাখছ?

উত্তর: তলিয়ে না দেখে কোনও কিছু ঘতলেই যারা গদ্য-পদ্য-গান-আঁকার মাধ্যমে একটা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন, তাঁরা ইনটেলেকচুয়াল বাফুন । ভারতের আণবিক বোমা তৈরি নিয়ে আমেরিকান, পাকিস্তানি ও ব্রিটিশ গবেষক এবং অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের লেখা বেশ কিছু বই আছে । প্রতিটিতেই বলা হয়েছেযে, ভারতীয় পোলিটিকাল এসট্যাবলিশমেন্টের অগোচরে, হোমি ভাবার সময় থেকে, বিজ্ঞানীদের একটা ছোট গোষ্ঠী আণবিক বোমা তৈরির চেষ্টা চালিয়ে গেছে, যার উদ্দেশ্য ছিল উন্নত দেশের বিজ্ঞানীদের কাছে নিজেদের জাহির করা । বাজেট বরাদ্দের দাবি ফি-বছর বাড়তে থাকায় পোলিটিকাল এসট্যাবলিশমেন্টের সন্দেহ হতে তারা প্রধানমন্ত্রীকে জানায় । কেননা বিভাগটা তাঁর অধীনে । প্রতিরক্ষমন্ত্রী ও সেনা জানত না । ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হলে তরিৎকর্মা বিজ্ঞানীরা তাঁকে নানা তর্কে রাজি করিয়ে ভূগর্ভে বিস্ফোরণ ঘটাল । বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া দেখে বিজ্ঞানীদের ওপর ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন ইন্দিরা । সোভিয়েত রাষ্ট্র ভেঙে পড়ায়, চিন নিউট্রন বোমা তৈরি করে ফেলায়, এবং নিজেদের রাজনৈতিক প্রয়োজন মেটাতে, বিজেপি দ্বিতীয় বিস্ফোরণ ঘটায় । মানবিকতার দৃষ্টিতে আণবিক বোমার তুলনায় ঘৃণ্য আবিষ্কার দ্বিতীয়টি নেই । কিন্তু রিয়াল পলিটিক ভিন্ন কথা বলে । বাঙালি রাজনীতিকরা ছেঁদো দলাদলির সময়ে রিয়াল পলিটিক করেন, অথচ বিশ্বের ঘটনাবলীর ক্ষেত্রে বিমূর্ত মানবতাবাদ ফলান । বুশ-ব্লেয়ার মাস্তানি ফলিয়ে যেভাবে ইরাকে যুদ্ধ করতে ঢুকে পড়ল, সাদ্দাম হুসেন চৌসেস্কুর মতন একজন নৃশংস অত্যাচারী তিলে খচ্চর একনায়ক মেনে নিয়েও বলতে হয়, যে, ইরাকের কাছে আত্মরক্ষার অস্ত্র থাকা প্রয়োজন ছিল । ইউ এন ইন্সপেক্টর-ফেক্টর সব ফালতু । বুশ আর তার কুবের বন্ধুরা ইরাক আক্রমণ আর দখলের ছক বহু আগে করে রেখেছিল, এমনকী কে কী পাবে সেটাও । হয়ত কখনও ইরাক দখল করবে ভেবে ওদের আণবিক পরিকাঠামোটাও বোমা ফেলে বহুকাল আগে ওড়ানো হয়েছিল । ভারত আগে থাকতে মিসাইল প্রযুক্তিতে উন্নতি করে তারপর বোমা ফাটিয়ে অন্তত এটুকু হুঁশিয়ারি দিয়ে রাখতে পেরেছে যে, তার কিছু হলে অন্তত এক হাত দেখে নেবে । চিন যেমন নিউট্রন বোমা বানিয়ে ফেলেছে, ভারতেরও তা তাড়াতাড়ি করে ফেলা দরকার । জেন-এর মিলিটারি ম্যাগাজিন অনুযায়ী, আণবিক শক্তিসম্পন্ন প্রতিটি দেশের মিসাইল কলকাতার দিকে তাক করা আছে, কেননা একটিমাত্র চোটে সবচেয়ে বেশি নাগরিকে এখানে যেভাবে ছাই করা যাবে, তা অন্য শহরে সম্ভব নয় । ইরাক যুদ্ধের ফলে বহু দেশ এবার গোপনে মারণাস্ত্রের ভাঁড়ার গড়বে, সম্ভবত একজন বয়ে নিয়ে যেতে পারে এমন গণবিদ্ধংসী অস্ত্র । পদ্য-যোগাড়েরা তাদের হেড মিস্ত্রিদের যুগিয়ে যাবে গলা-কাঁপানো পদ্য । আমেরিকার বিশ্ববাজার আছে, তো পদ্য যোগাড়েদের আছে বুকনিবাজার । সম্প্রতি টিভিতে দেখলুম তথাকথিত নকশালপন্হী একদল পাঁচফুটিয়া ছেলেমেয়ে শেক্সপিয়ার সরণিতে একটা দোকানে এই অজুহাতে ভাঙচুর করল যে তারা মার্কিনী জুতো বিক্রি করে । একটি মেয়ে জিন্সের টপ আর টাইটবটম পরে ভাঙচুর করছিল । অর্থাৎ সে নিজেই মার্কিনী পোশাকে ছিল । অর্থনীতি সম্পর্কে কোনও ধারণা নেই ছেলেমেয়েগুলোর । দোকানটা মারোয়াড়ির, টাকা তার, জুতোগুলো ভারতীয় শ্রমিকরা বানায় । ওসব না করে ওদের উচিত ছিল ফিদাইন হয়ে ইরাকে লড়তে যাওয়া । ফ্রাংকোর বিরুদ্ধে ইউরোপীয় বুদ্ধিজীবীরা লড়তে গিয়েছিল । যে নেতার কাজ অপছন্দ হতো, তিনি যে দেশেরই হোন, অ্যালেন গিন্সবার্গ তাঁদের যাচ্ছেতাই চিঠি লিখত ।

প্রশ্ন: তোমার জন্মের এক মাস আগে জার্মানি আর সোভিয়েত রাশিয়া পোল্যান্ড আক্রমণ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু করেছিল । সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষ মারা গিয়েছিল সেই যুদ্ধে, দু কোটি কেবল সোভিয়েত রাশিয়ার । তুমি যখন ক্যাথলিক স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে পড়ছ, তখন হিরোশিমা-নাগাসাকিতে আণবিক বোমা ফেলা হয়েছিল যার ফলে তিন লক্ষ মানুষ মারা যান । তোমার যখন এক বছর বয়স, তখন ছাব্বিশ হাজার মানুষকে পোল্যান্ডের কাতি জঙ্গলে স্তালিনের নির্দেশে খুন করা হয়েছিল । ষাট লক্ষ ইহুদিকে বিষাক্ত গ্যাসে আর ইনসিনেটারে পুড়িয়ে মেরেছিলেন হিটলার । কত লক্ষ বিরোধী-নামাঙ্কিত মানুষকে স্তালিন, কাম্পুচিয়ার পল পট, জানারাল পিনোশে, ইদি আমিন, সুহার্তো, ট্রজিলিও, মোল্লা ওমর, দুভালিয়ের, টিক্কা খান, বিদেশের মাটিতে বাবা বুশ ছেলে বুশ মেরে ফেলেছেন । তোমার জীবদ্দশায় লক্ষ-লক্ষ মানুষকে একযোগে মেরে ফেলার জন্যে অ্যানথ্রাক্স, স্মল পক্স, বটুলিনাম, রাইসেন, টুলারেনসিস, নিউমোনিক প্লেগ, মাস্টার্ড গ্যাস, সারিন গ্যাস ইত্যাদি মারণাস্ত্র আবিষ্কার ও প্রয়োগ হয়েছে । অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনোও না কোনোও আদশফের নামে গণহত্যাগুলোকে ন্যায্যতা দেওয়া হয়েছে । সারাটা জীবন অমন দূষণের ভেতরে বাস করে তুমি নিজেও কি দূষিত হয়ে যাওনি? তোমার কি সন্দেহ হয়না যে অমন দূষণ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখাটাই বরং অপরাধ? এরকম আবর্তে বসে কবিতা লিখতে অপরাধ বোধ কর না? কেমন মানুষ তুমি?

উত্তর: হ্যাঁ । নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা, নৃশংসতার যে সামগ্রিক ডিসকোর্সের সঙ্গে জন্মাবধি পরিচিত হয়ে চলেছি, এবং যেভাবে তা দেশে দেশে রাষ্ট্রীয়, জাতীয়তাবাদী, ধর্মীয়, এথনিক, ট্রাইবাল, গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক, রাজনৈতিক, আর্থিক বৈধতা পেয়েছে, তা ব্যক্তির অন্তরাত্মা ধাঁচের ধারণার অ্যাবসার্ডিটিতে আমি আক্রান্ত । হত্যাযজ্ঞ একজনের কর্মকাণ্ড নয় । তা অজস্র মানুষের আনুগত্যের যান্ত্রিক দক্ষতা থেকে উপজাত । জনমুক্তি, মানবতাবাদ, মানুষই পৃথিবীর কেন্দ্র, কমরেড তুমি নবযুগ আনবে, মানুষকে অবিশ্বাস করা পাপ, সততা, উত্তরণ, ধ্রুবসত্য, যুক্তিপ্রাণতা, ইতিহাসের প্রগতি, সার্বভৌম একক মন, ব্যক্তিচেতনা, বিপ্লবের মাধ্যমে সামাজিক সুস্হতা ইত্যাদি, গ্রমীণ লিটল ম্যাগাজিনের অজ্ঞান-অবোধ ডিসকার্সিভ স্পেস হিসেবে কেবল টিকে আছে । আমি যে কেবলমাত্র সন্দেহে আক্রান্ত, সেখানেই যে এই প্রবলেম্যাটিকের সমাপ্তি, তা কিন্তু নয় । পশ্চিম বাংলার ম্যাক্রোলেভেল ও মাইখপলেভেল ঘটনাবলীর দ্বারা প্রতিনিয়ত ফুটে উঠছে বাগাড়ম্বরের ইডিয়সি । যারা বলেছিল যে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে এসট্যাবলিশমেন্টকে ধ্বংস করাটা সাম্যবাদের অভিমুখ, তাদের তো চেয়ারে বসে-বসে ফিসচুলা হয়েগেছে । আমাএ সাবজেক্ট পোজিশান ওই উনিশ শতকীয় এনলাইটেনমেন্টের পৃষ্ঠপটে যদি দূষিত মনে হয় তো তার উৎসসূত্র ওই একই ডিসকোর্স । বদ্ধ উন্মাদ বা খবরের কাগজে ঘটনা-নির্লিপ্ত প্রবন্ধ-লেখকরাই শুধু নিজেদের দূষণমুক্ত মহাপুরুষ বলে মনে করতে পারেন, কেননা তাঁদের যন্ত্রণায় ছটফট করার প্রয়োজন হয় না । আমি তাই আমার এই সাবজেক্ট পোজিশানকে পারক্য আক্রান্ত বা এলিয়েনেটেদ বলব না । কেননা, তুমি যার সাক্ষাৎকার নিচ্ছ, সে single agent নয়, তার 'অ্যানোমি' ঘটা সম্ভব নয় । আমি যে আপোষ করিনা, আর dissenting voice গুলো বজায় রাখতে পেরেছি, তাও কিন্তু আমার সাবজেক্ট পোজিশানকে অবিরাম যাচাই করতে থাকার কারণে । অমন জাগতিক ধ্বংসকাণ্দের মাঝে জন্মাবধি বাস করে, কবিতা-গল্প-উপন্যাস লেখার নৈতিক প্রয়োজনীয়তার সন্দেহটা থেকেই যায় । সাহিত্য ব্যবসায়ী হলে নিরেট অজ্ঞানতার কোকুনে সন্দেহহীন আরামে থাকতুম । সন্দেহহীন হওয়াটা, আমার মনে হয়, ক্রমিনালের মতন আচরণ হয়ে যাবে । যদিও জানি যে আমার ভাবনাচিন্তার চাপটাই আমার হার্ট অ্যাটাক দুটোর অন্যতম কারণ ।

প্রশ্ন: তুমি যখন থেকে লেখালিখি করছ, তখন থেকেই জোব চার্ণককে কলকাতার পিতৃত্ব দেবার বিরোধিতা করে আসছ । কলকাতায় ফিরে আসার পর সাবর্ণ চোধুরী পরিবার পরিষদে অংশ নিয়েছ, যাতে জোব চার্ণককে পিতৃত্ব দেয়া নাকচ হয় । প্রথম সাবর্ণ চৌধুরী লক্ষ্মীকান্ত রায়চৌধুরীর জীবন নিয়ে লিখেছ কবিতীর্থ পত্রিকায় । নবম শতক থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত নিজের সাবর্ণ চৌধুরী লিনিয়েজ নিয়ে দিশা পত্রিকায় লিখেছ । এটা কি তোমার পোস্টকলোনিয়াল ডিসকোর্স ? নাকি জোব চার্ণককে উৎখাত করার মধ্যমে সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের প্রতিশোধ নিলে? কেননা রাধাকান্ত দেবের পরিবার সুতানুটি পরিষদ জোব চার্ণককে কলকাতার পিতৃত্ব দিতে উঠে-পড়ে লেগেছিল । আর রাধাকান্ত দেবের পূর্বজই ক্লাইভকে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে, আর্থিক ও স্ট্র্যাটেজিক সাহায্য করেছিল । ইংরেজ ও নবাবপক্ষের অবর্তমানে, তাদের লড়াইটা কি গোপনে কলকাতার দুই আদি পরিবারের মধ্যে আজও চলছে? তুমি কী উদ্দ্যেশ্যে এই বিতর্কে জড়িয়ে পড়লে, যার সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্ক নেই?

উত্তর: ইংরেজরা কলকাতার একশ বছর, কলকাতার দুশ বছর চিহ্ণিত করে কোনও উৎসব পালন করেনি । যারা তিনশ বছর পালন করার হুজুগটা করল, তাদের একটা অংশ সেই পরিবারের রেলিকস যারা সিরাজের বিরুদ্ধে ক্লাইভকে সাহায্য করে সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠায় খুঁটি হিসেবে কাজ করেছিল । কিন্তু সবচেয়ে বিরক্তিকর ও অসহ্য লাগল সেইসব লোকগুলোর কাজকারবার, যাঁরা স্বঘোষিত বামপন্হী ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী । কলকাতার রাস্তাঘাত, মাঠ-ময়দান সর্বত্র থেকে যখন সাম্রাজ্যবাদীদের মূর্তিগুলো উপড়ে লোপাট করা হয়েছে, তখন আশ্চর্য হয়ে গেলুম দেখে যে স্কুলের পাঠ্যবইতে সাম্রাজ্যবাদের এজেন্ট জোব চার্ণকের মূর্তি বসন হয়েছে, এই ফিকশনের মাধ্যমে যে, তিনি কলকাতা শহরের বাবা । আসলে পশ্চিম বাংলায় নিজেদের বৈধ ও ন্যায্য প্রমাণ করার জন্যে পাকিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তুরা রাজনৈতিক রিরুটিং হিসেবে এই কাণ্ডটি ঘটিয়েছেন । বহিরাগতরা যেখানে গেছে সেখানকার ইতিহাস বিকৃত করেছে । হাওয়া৪৯ এর অপর সংখ্যায় আদি কলকাতার অপর শিরোনামে কৌশিক পরামাণিক ওনার প্রবন্ধে দেখিয়েছেন, সরকারি ইতিহাসকাররা কলিকাতার তিনশত বৎসরের জীবনপঞ্জী বইটায় কী কেলো করেছেন । হাওয়া৪৯-এ উত্তরঔপনিবেশিকতা নিয়ে একটা দীর্ঘ প্রবন্ধ লেখার সময়ে তধ্য খুঁজতে বসে রাগ ধরে গেল সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান বইতে জোব চার্ণক আর লক্ষ্মীকান্ত রায়চৌধুরীর এন্ট্রি দুটো পড়ে । জোব চার্ণক সম্পর্কে এন্ট্রিটা ভুল তথে্য ঠাসা, এবং গাঁজাখুরি । সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত আর অঞ্জলি বসু কোথা থেকে ওসব জুটিয়েছেন জানি না । তবে ওনাদের সাবজেক্ট পোজিশান যে মোটিভেটেদ তা স্পষ্ট হয়ে গেল আমার পূর্বজের এন্ট্রিটা পড়া । পদবিসহ নাম না দিয়ে লেখা হয়েছে কেবল লক্ষ্মীকান্ত, জন্ম-মৃত্যু সন নেই, তথ্য ভুল এবং ভাসা-ভাসা, যখন কিনা লক্ষ্মীকান্তর উত্তরপুরুষ অতুলকৃষ্ণ রায়ের লেখা এ শর্ট হিস্ট্রি অব ক্যালকাটা বইটা, যার ভূমিকা লিখেছিলেন নিশীথরঞ্জন রায়, তা ওনাদের কাছেই ছিল । এই সময়েই বড়বাড়ি আর সাবর্ণ পাড়ার গোরাচাঁদবাবু, স্মরজিৎবাবু, কানুপ্রিয়বাবু জোব চার্ণককে কলকাতার বাবা বানাবার বিরুদ্ধে মামলা করার তোড়জোড় করছিলেন । সাম্রাজ্যবাদ আসার আগে হিন্দু বাঙালির বাপ-চোদ্দোপুরুষের ইতিহাস খতিয়ান রাখত ঘটক সম্প্রদায় আর পুরীর পাণ্ডারা । ধার্মিক আচার-আচরণের বাইরে তার গুরুত্ব এই ছিল যে, লোকে নিজের ভৌগলিক আর ঐতিহাসিক শেকড়ের সঙ্গে সম্পর্কিত থাকত, যা তার মধ্যে সক্রিয় রাখত এই বোধ যে, সে পোকা-মাকড় জন্তু-জানোয়ার নয় । কিন্তু ইউরোপীয় মননবিশ্বে নির্মিত নাগরিক বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে তার পারিবারি আর ভৌগলিক স্মৃতি থেকে । আজকের বিশ্বের বহু সমস্যার বীজ ওই উত্তরঔপনিবেশিক স্মৃতিবিপর্যয়, এবং নব্য-সাম্রাজ্যবাদি এনট্রপি । সাহিত্যিক হিসেবে পারিবারিক শেকড়ের স্মৃতিচর্চার মাধ্যমে আমি গভীর বাঙালিত্বে প্রবেশ করি, যা মুর্শিদাবাদ, গৌড়, সরকার সাত গা্ঁ, তাম্রলিপ্তে আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে আদি বাঙালিত্বের স্পেস তৈরি করে । আমার লেখালিখিতে এই স্পেস হাংরি আন্দোলনের সময় থেকে মোটিভ ফোর্স রূপে আছে । হাংরি বুলেটিন, যেটা আমার জেনারেশনের >কাব্যদর্শন বা মৃত্যুমেধী শাস্ত্র নামে প্রকাশিত হয়েছিল, সেটা মহারাজ প্রতাপাদিত্যকে উৎসর্গ করেছিলুম । পোস্টমডার্ন ভাবনা ও সমাজ বিশ্লেষণে আমার দাদা সমীর রায়চৌধুরীর আগ্রহ, এই বিশেষ স্পেসটির সূত্রে । প্রথম যিনি ১৯৩৪ সালে পোস্টমডার্ন শব্দটি প্রয়োগ করেন, নিকারাগুয়ার কবি ফেদেরিকো দ্য ওনিস, তা করেছিলেন প্রক্তন উপনিবেশের মানুষগুলোর স্মৃতি বিপর্যয়ের প্রেক্ষিতে । মুম্বাইতে থাকতে, আর্জেন্টিনার এক তরুণ কবিগোষ্ঠী আমার সম্পর্কে একটি স্প্যানিশ ওয়েবসাইট খুলেছেন খবর পেয়ে, ১৯৮৯ সালে নেট সার্ফিং করতে বসে ফেদেরিকো দ্য ওনিস সম্পর্কে জানতে পারি ।

প্রশ্ন: তোমাকে নিয়ে, তোমার নাম উল্লেখ করে বহু ওয়েবসাইট আছে । বইপত্র তবু কিছুদিন থাকে । কিন্তু ওয়েবসাইট যে থাকবে না, মুছে যাবে, তা কি পীড়িত করে না তোমায়? ইন্টারনেটের কারণে চিঠিপত্র সংগ্রহে রাখাটাও তো সম্ভব নয় । সাহিত্যের যে সাময়িক অবিনশ্বরতা ছিল, তাও শেষ হয়ে গেল । তোমায় হন্ট করে না ?

উত্তর: ওয়েবসাইটগুলোয় যে আমি আছি তা জানতে পারি নেট সার্ফিং শিখতে গিয়ে । আমার সম্পর্কে কে কী লিখেছে, কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার চিঠি বা হাংরি বুলেটিন রেখেছে, কোন গ্রন্হে আমার কবিতা অন্তর্ভূক্ত হয়েছে, সে সব জানার আহ্লাদ আছে । অনেকে ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটে মাঝে মধ্যে কবিতা সংকলিত করেন, তাতে আমার কবিতাও থাকে, যদিও তা কয়েকমাসের জন্যে । অনেকে ই-মেল করে গল্প বা কবিতা পড়ার জন্যে পাঠান । আমার তো বাড়িতে ব্যবস্হা নেই, সাইবার কাফেতে ঢুঁ মারতে হয় । আঙুলে ব্যথার জন্যে অসুবিধে হয় । এ ঠায় বসে থাকাও কষ্টকর । অবিরাম পরিবর্তনরত একটা ব্যাপারের মধ্যে আছি, তার মৌজমস্তি উপভোগ করি । কলকাতার সাহিত্যিকি নোংরামির বাইরে বেশ স্বস্তিদায়ক অবস্হান । সাহিত্যিক অবিনশ্বরতা ব্যাপারটা ফালতু । তরুণ কবি-লেখকরা দেখি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর পড়েন না , অথচ তিনি, ঢাকার আব্দুল হালিম বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথকে প্রভাবিত করেছিলেন । বেঁচে থাকতেই তো দেখছি আমার নামের ইমেজ আমার লেখাপত্রকে ছাপিয়ে যাচ্ছে । মগজের দেয়ালে হরপ্পা-মহেঞ্জোদারো, মিশরের পিরামিড, রোমের কলোসেয়াম, মাম্মালাপুরমের মন্দির, কুমহারারে সম্রাট অশোকের প্রাসাদের পাথরটুকরো ইত্যাদির ছবি টাঙিয়ে রাখলে অযথা দুশ্চিন্তার দুর্ভোগ থেকে মুক্ত থাকা যায় । বড়জ্যাঠা পাটনা মিউজিয়ামে কাজ করতেন বলে আমি স্কুলে পড়ার সময় ছুটির দিনগুলো সেখানেই কাটাতুম । তাই সময় ও সময়হীনতার ধারণা তখন থেকে গড়ে ওঠে । মুছে যাওয়াটা সেহেতু হন্ট করে না ।

প্রশ্ন: তুমি কি নিজেকে হিন্দু বলে মনে করো? হিন্দুদের দেবী-দেবতা, ইষ্টদেবতা আর ঈশ্বরে বিশ্বাস করো? হিন্দুর উৎসবে অংশ নাও? হিন্দুরা যদি অন্য ধর্মের লোকেদের দ্বারা আক্রান্ত হয়, যেমন কাশ্মিরি পণ্ডিত রা, তাহলে কি ইন্সটিংক্টলি রিঅ্যাক্ট করো? মরে গেলে ডাক্তারি ছাত্রদের জন্যে তোমার দেহ দান করে দেবে? তুমি কি চাইবে গঙ্গার ধারে, তোমার বাপ-ঠাকুর্দার বসতবাটি উত্তরপাড়ায় তোমার শেষকৃত্য হোক? নশ্বর শবের মাধ্যমে কি ইমেজকে পূর্ণতা দিয়ে যেতে চাও, যেমনটা রাজনীতিক-সাহিত্যিক-শীল্পীরা করেন? বয়েস তো হয়ে গেল, এখনও পর্যন্ত নিজের মৃত্যুকে গ্লোরিফাই করে কবিতা লেখোনি তো?

উত্তর: হ্যাঁ, আমি একজন হিন্দু । এই জন্যে যে আমি চাই মরে গেলে আমার দেহ পোড়ানো হোক । সবাই জন্মসূত্রে হিন্দু হয় । আমি মৃত্যু সূত্রে । পারিবারিক ইষ্ট দেবতা, সাবর্ণচৌধুরী হবার সুবাদে, কালীঘাটের কালী আর শ্যামরায়, যাঁদের থেকে, ঠাকুমার আমল থেকে, ঠাকুমার মানসিকতা ও দাপটের কারণে, আমার আগের প্রজন্ম মুক্ত হয়ে গিয়েছিল । বাবাকে কখনও কোনো মন্দিরে যেতে দেখিনি, যদিও উনি পৈতে পরা, গায়ত্রীমন্ত্র, খাবার সময়ে গণ্ডুষ ইত্যাদি সম্পর্কে গোঁড়া ছিলেন, পাঁজি-পুঁথি মানতেন না । মা সেসব কিচ্ছু মানতেন না, এমনকি অন্য ধর্মের মেয়ে বিয়ে করার ওপন পারমিশান দিয়ে রেখেছিলেন উনি । আমার সাবজেক্ট পোজিশানের বহুত্বের উৎস আমার শৈশবের পাড়াগুলো তো বটেই, আমার বাবা-মা, জেঠিমা-জ্যাঠা, কাকিমা-কাকার মতাদর্শের বৈভিন্ন্যের অবদানও তাতে আছে । আমার বয়ঃসন্ধির যৌনউন্মেষ হয়েছিল একজন শিয়া মুসলমান তরুণির সংসর্গে, এবং কবিতার জগতে প্রবেশও । এ-ব্যাপারে আমার একটা কবিতা আছে, প্রথম প্রেম: ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ শিরোনামে । প্রাথমিক স্তরে পড়েছি ক্যাথলিক মিশনারি স্কুলে, তখন প্রতিদিন চার্চে যেতে হত । তারপর ব্রাহ্ম স্কুলে । আমার মস্তিষ্কে ঈশ্বর বিশ্বাসের ওই বীজ অংঙ্কুরিত হতে পারেনি । চেষ্টা করেও না । ডুবজলে যেটুকু প্রশাস-এর অতনু, আর নামগন্ধ উপন্যাসে অরিন্দম এবং যিশু বিশ্বাস চরিত্রগুলোয় আমি এই মনস্হিতি আর্টিকুলেত করার চেষ্টা করেছি । দুটি স্কুলেই হিন্দু উৎসব নিষিদ্ধ ছিল । পাড়ার প্রধান উৎসব ছিল দোলখেলা, যাতে অংশ নিতুম, এখন বয়সের কারণে নিই না । গণহত্যা শুনলেই গাগুলোয়, টিভিতে দেখলেই বন্ধ করে দিতে হয় । পার্ক স্ট্রিট মেট্রো স্টেশানের সামনেই দুজনকে থেঁতলে দেয়ালে গেঁথে দিতে, সঙ্গে-সঙ্গে সরবিট্রেট রাখতে হল জিভের তলায় । ইন্সটিংক্ট এখন এই স্তরে । তবে পাকিস্তান রাষট্রটিকে আমি ভারতের পক্ষে ক্ষতিকর মনে করি । তাদের জণভেই হিন্দিত্ব নামক দানবটি পয়দা হবার সুযোগ পেয়েছে । রাষ্ট্রধর্ম কনসেপ্টটাই দুর্বৃত্তসুলভ । রাষ্ট্রের আবার ধর্ম হয় নাকি? তাহলে তো পথঘাট-লাউকুমড়ো কাক-কোকিলেরো ধর্ম থাকবে । দেহ দান করার ব্যাপারটা নিছক নৌটঙ্কি । গুদামের চেলাকাঠের ডাঁইয়ের মতন মর্গগুলোয় বেওয়ারিশ লাশের পাহাড় জমে থাকে । এসকেপিস্টরা আর যে প্রাক্তন উদ্বাস্তুরা পশ্চিম বাংলার মাটিতে নিজেকে মিশিয়ে দিতে অনিচ্ছুক তাঁরা, ওটা করেন । মরার সময়ে মুম্বাইতে থাকলে চোখদুটো কারোর কাজে লাগবে । উত্তরপাড়ার যে-ঘাটে সাবর্ণচৌধুরীদের শেষকৃত্য হত, সেখানে বহুকাল আগে শবদাহ নিষিদ্ধ হয়ে গেছে । বেস্ট হবে কিউ না দিয়ে ইলেকট্রিক চুল্লিতে ঢুকতে পারা । মৃত্যুকে গ্লোরিফাই করার সাহিত্যিক ক্যাননটা উপনিবেশগুলোয় এনেছে ইঊরোপ । যার শব পোড়ানো হবে, তার এপিটাফ লেখার মতন ইডিয়টিক ব্যাপার আর দ্বিতীয়টি নেই । মৃতদেহ ঘিরে ফিউনারাল সং গাওয়াটাও বাঙালির সাংস্কৃতিক আচরণ নয় । মৃত্যুর পর স্মরণসভা ব্যাপারটাও আমার অভিপ্রেত নয় । আমি অমন স্মরণসভাগুলো এঢ়িয়ে যাই । লক্ষ-লক্ষ বাঙালির মতন আমিও সাধারণ স্বাভাবিক অবলুপ্তি চাই । আপাতত দুর্গাপুজোর নবমীর দিন বড়বাড়ি আর আটচালায় নানা এলাকা থেকে এসে সাবর্ণচৌধুরীদের যে জমায়েট হয়, ১৬১০ থেকে হয়ে আসছে, তাতে অংশ নেয়া আর খাওয়ায় সীমিত হয়ে গেছে ধর্মকর্ম।